জড় বৈশিষ্ট্য (Non-living Characteristics) | |
---|---|
প্রোটোপ্লাজমের অভাব | ভাইরাসের মধ্যে সাইটোপ্লাজম এবং অন্যান্য কোশীয় অঙ্গাণু অনুপস্থিত। |
কেলাসিত হওয়ার ক্ষমতা (Crystallization) | টোব্যাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV) এবং পোলিওমাইলাইটিস ভাইরাসের মতো ভাইরাসকে কেলাসিত করা যায়, যা সাধারণত জড় বস্তুর বৈশিষ্ট্য। |
স্বাধীনভাবে বাঁচতে অক্ষম | সজীব কোশের বাইরে ভাইরাস কোনো প্রকার জৈবিক কার্যকলাপ দেখাতে পারে না। এদের নিজস্ব কার্যকারিতা (functional autonomy) নেই। |
উচ্চ আপেক্ষিক গুরুত্ব (High specific gravity) | এটি সাধারণত জড় বস্তুর ক্ষেত্রেই দেখা যায়। |
শ্বসনের অনুপস্থিতি | ভাইরাসের নিজস্ব কোনো শ্বসন প্রক্রিয়া নেই। |
শক্তি সঞ্চয়কারী তন্ত্রের অভাব | এদের মধ্যে শক্তি সঞ্চয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। |
বৃদ্ধি ও বিভাজনের অনুপস্থিতি | জীবন্ত কোশের বাইরে ভাইরাস আকারে বৃদ্ধি পায় না বা কোশ বিভাজনের মাধ্যমে সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারে না। |
জীবজ বৈশিষ্ট্য (Living Characteristics) | |
জৈব ম্যাক্রোমলিকিউল দিয়ে গঠিত | ভাইরাসের দেহ জৈব অণু যেমন প্রোটিন এবং নিউক্লিক অ্যাসিড (DNA অথবা RNA) দিয়ে তৈরি। |
জেনেটিক উপাদানের উপস্থিতি | ভাইরাসের মধ্যে বংশগতির উপাদান হিসেবে DNA অথবা RNA বিদ্যমান। |
বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা | সজীব কোশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ভাইরাস তার জেনেটিক উপাদান ব্যবহার করে নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। |
মিউটেশন ঘটার প্রবণতা | ভাইরাসের জিনগত উপাদানে পরিবর্তন বা পরিব্যক্তি (mutation) ঘটতে পারে। |
কিছু এনজাইমের উপস্থিতি | কিছু ভাইরাসের মধ্যে নিউরামিনিডেজ (প্রথম আবিষ্কৃত), ট্রান্সক্রিপ্টেজ এবং লাইসোজাইমের মতো এনজাইম দেখা যায়। |
সংক্রমণ ও পোষক নির্দিষ্টতা (Infectivity and host specificity) | ভাইরাস সজীব কোশকে সংক্রমিত করতে পারে এবং সাধারণত এরা নির্দিষ্ট পোষক কোশের জন্যই বিশেষিত হয়। |
জীবাণুমুক্তকরণে ধ্বংস হওয়া | অটোস্লেইভিং এবং অতিবেগুনী রশ্মির মাধ্যমে ভাইরাসকে ধ্বংস করা যায়। |
পোষক কোশের জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া ব্যবহার | ভাইরাস পোষক কোশের জৈব রাসায়নিক পদ্ধতিকে নিজেদের প্রতিলিপি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান উৎপাদনে ব্যবহার করে। |
সংক্রামক রোগের কারণ | ভাইরাস সাধারণ ঠান্ডা, মহামারী ইনফ্লুয়েঞ্জা, চিকেন পক্স, মাম্পস, জলাতঙ্ক, হার্পিস, এইডস, সার্স ইত্যাদির মতো অসংখ্য সংক্রামক রোগের জন্য দায়ী। |
ভাইরোলজির আবিষ্কারসমূহ
"ভাইরাস" শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ virus থেকে, যার অর্থ বিষ বা বিষাক্ত তরল। এই শব্দটি লুই পাস্তুর ১৮৮০ সালে ব্যবহার করেন।
ডি. জে. ইভানোস্কি (D.J. Ivanowsky) ১৮৯২ সালে দেখতে পান যে কিছু অতি ক্ষুদ্র জীবাণু তামাক গাছের মোজাইক রোগের কারণ। এই জীবাণুগুলো ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী ছাঁকনির মধ্য দিয়ে চলে যেতে পারে, অর্থাৎ এরা ব্যাকটেরিয়ার চেয়েও ছোট।
এম. ডব্লিউ. বেইজেরিঙ্ক (M.W. Beijerinck) ১৮৯৮ সালে প্রমাণ করেন যে আক্রান্ত তামাক গাছ থেকে প্রাপ্ত নির্যাস সুস্থ গাছে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। তিনি এই তরলকে নাম দেন Contagium vivum fluidum, যার অর্থ সংক্রামক জীবন্ত তরল।
ভাইরাসের গঠন উপাদানসমূহ
- এনভেলপ (Envelope): কিছু ভাইরাসের বাইরের দিকে একটি অতিরিক্ত স্তর থাকে যাকে এনভেলপ বলা হয়। এটি লিপিড ও প্রোটিন দ্বারা গঠিত এবং হোস্ট কোষে প্রবেশে সহায়তা করে।
- ক্যাপসিড (Capsid): এটি একটি প্রোটিন কোট যা ভাইরাসের জিনগত উপাদানকে ঘিরে রাখে এবং ভাইরাসকে সুরক্ষা দেয়।
- নিউক্লিওয়েড (Nucleoid): ভাইরাসে হয় DNA অথবা RNA থাকে (দু’টি একসাথে নয়)। এখানে ভাইরাসের জিনগত উপাদান থাকে।
ক. DNA ধারণকারী ভাইরাস (Deoxy viruses):
- i. ডাবল স্ট্র্যান্ডেড DNA (dsDNA) ভাইরাস: উদাহরণ: পক্স ভাইরাস, ফুলকপি মোজাইক ভাইরাস, হারপিস ভাইরাস।
- ii. সিঙ্গেল স্ট্র্যান্ডেড DNA (ssDNA) ভাইরাস: উদাহরণ: কোলিফেজ ৪×১৭৪, এম১৩ ফেজ।
খ. RNA ধারণকারী ভাইরাস (Riboviruses):
- i. ডাবল স্ট্র্যান্ডেড RNA (dsRNA) ভাইরাস: উদাহরণ: রিওভাইরাস, উন্ড টিউমার ভাইরাস।
- ii. সিঙ্গেল স্ট্র্যান্ডেড RNA (ssRNA) ভাইরাস: উদাহরণ: TMV, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ ভাইরাস, রেট্রোভাইরাস (যেমন: HIV)।
হোস্ট ভিত্তিতে ভাইরাসের শ্রেণীবিভাগ
ভাইরাসকে তাদের হোস্টের ধরন অনুযায়ী ৩টি প্রধান গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রতিটি গ্রুপের ভাইরাসের জিনগত উপাদান (জিনোম) আলাদা হয়:
১. ফাইটোফ্যাজিনি/গাছের ভাইরাস (Plant Viruses)
- জিনোম: একসূত্রক RNA (ssRNA)
- উদাহরণ:
- টোব্যাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV)
- পোটেটো ভাইরাস Y - বৈশিষ্ট্য:
- গাছের পাতা, কাণ্ডে দাগ/মোজাইক প্যাটার্ন তৈরি করে
- পোকা বা যান্ত্রিক মাধ্যম (কাটিং টুলস) দিয়ে ছড়ায়
২. জুফ্যাজিনি/প্রাণীর ভাইরাস (Animal Viruses)
- জিনোম: একসূত্রক বা দ্বিসূত্রক RNA/DNA (ss/dsRNA বা dsDNA)
- উদাহরণ:
- DNA ভাইরাস: হার্পিস, হেপাটাইটিস B
- RNA ভাইরাস: ইনফ্লুয়েঞ্জা, HIV, রেবিস - বৈশিষ্ট্য:
- মানুষ ও প্রাণীর রক্ত, শ্বাসতন্ত্র ইত্যাদি আক্রমণ করে
- ড্রপলেট, রক্ত বা যৌন সংস্পর্শে ছড়ায়
৩. ব্যাকটেরিওফাজ/ব্যাকটেরিয়ার ভাইরাস (Bacteriophages)
- জিনোম: দ্বিসূত্রক DNA (dsDNA)
- উদাহরণ:
- T4 ফাজ (ই. কোলাই আক্রমণ করে)
- ল্যাম্বডা ফাজ - বৈশিষ্ট্য:
- ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে ("ভাইরাসের শিকারী")
- আণবিক জীববিজ্ঞানে গবেষণায় ব্যবহৃত
সারণীর মাধ্যমে তুলনা
গ্রুপ | জিনোমের ধরন | হোস্ট | উদাহরণ |
---|---|---|---|
গাছের ভাইরাস | ssRNA | উদ্ভিদ | TMV, পোটেটো ভাইরাস |
প্রাণীর ভাইরাস | ss/dsRNA বা dsDNA | মানুষ/প্রাণী | HIV, ইনফ্লুয়েঞ্জা |
ব্যাকটেরিওফাজ | dsDNA | ব্যাকটেরিয়া | T4 ফাজ, ল্যাম্বডা |
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
- ✔ প্রাণীর ভাইরাস সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় (DNA/RNA উভয়ই হতে পারে)।
- ✔ ব্যাকটেরিওফাজ অ্যান্টিবায়োটিক বিকল্প হিসেবে গবেষণাধীন ("ফাজ থেরাপি")।
- ✔ গাছের ভাইরাস কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি করে (যেমন: টমেটো ইয়েলো লিফ কার্ল ভাইরাস)।
নোট :-
- ssRNA = Single-Stranded RNA
- dsDNA = Double-Stranded DNA
টোব্যাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV) - গঠন
আকৃতি ও মাত্রা
- টোব্যাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV) একটি লম্বাটে রডের মতো আকৃতির ভাইরাস।
- এর দৈর্ঘ্য ৩০০০ Å (অ্যাংস্ট্রম) এবং ব্যাস ১৮০ Å।
- এর আণবিক ওজন ৩৯.৪ × ১০⁶ ডাল্টন।
ক্যাপসিডের গঠন
TMV-এর প্রোটিন খোলক (ক্যাপসিড) ২১৩০টি ক্যাপসোমিয়ার (প্রোটিন একক) দ্বারা গঠিত, যা পেঁচানো সর্পিলাকারে (হেলিক্যালি) সাজানো থাকে।
RNA-এর গঠন
- ভাইরাসটির জিনোম একটি একসূত্রক RNA (ssRNA), যা সর্পিলাকারে বিন্যস্ত।
- এই RNA-এ ৬৪০০টি নিউক্লিওটাইড রয়েছে।
নিউক্লিওটাইড ও ক্যাপসোমিয়ারের অনুপাত
নিউক্লিওটাইড সংখ্যা (৬৪০০) এবং ক্যাপসোমিয়ার সংখ্যা (২১৩০)-এর অনুপাত ৩ : ১।
অর্থাৎ, প্রতি ১টি ক্যাপসোমিয়ারের জন্য ৩টি নিউক্লিওটাইড রয়েছে।
এই গঠন TMV-কে তার সংক্রমণ ক্ষমতা ও স্থায়িত্ব প্রদান করে।
ব্যাকটেরিওফাজ (ব্যাকটেরিয়ার ভাইরাস): গঠন ও কার্যাবলী
১. পরিচয়
ব্যাকটেরিওফাজ (বা ফাজ) হল এমন ভাইরাস যা ব্যাকটেরিয়াকে সংক্রমিত করে। এদের দ্বিসূত্রক DNA (dsDNA) জিনোম থাকে এবং এরা ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে ("ভাইরাসের শিকারী")।
২. গঠন (T4 ফাজের উদাহরণে)
একটি ব্যাকটেরিওফাজ দেখতে ব্যাঙাচির মতো (Tadpole-shaped) এবং এর দুটি প্রধান অংশ:
ক) হেড (মাথা)
আকৃতি: বহুভুজাকার (Polyhedral)
গঠন:
ক) মাথা (Head):
- আকার: ব্যাকটেরিওফাজ এর মাথা সাধারণত বহুভুজাকার (icosohedral) হয়, অর্থাৎ এটি ২০টি ত্রিকোণাকার তল দ্বারা গঠিত একটি প্রায় গোলাকার কাঠামো। কিছু ক্ষেত্রে এটি লম্বাটে বা ডিম্বাকৃতিরও হতে পারে।
- অভ্যন্তরীণ উপাদান: মাথার অভ্যন্তরে ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান অর্থাৎ নিউক্লিক অ্যাসিড (সাধারণত দ্বিসূত্রক DNA) অত্যন্ত ঘনভাবে প্যাকেজ করা থাকে।
- ক্যাপসিড: নিউক্লিক অ্যাসিড একটি প্রোটিন নির্মিত আবরণের মধ্যে আবদ্ধ থাকে, যাকে ক্যাপসিড বলে। ক্যাপসিড অসংখ্য ছোট ছোট প্রোটিন সাবইউনিট দিয়ে গঠিত, যাদের ক্যাপসোমিয়ার (capsomere) বলা হয়। এই ক্যাপসোমিয়ার বিন্যাস মাথার নির্দিষ্ট আকার প্রদান করে এবং নিউক্লিক অ্যাসিডকে রক্ষা করে।
- কলার (Collar) : মাথা এবং লেজের সংযোগস্থলে একটি ছোট কাঠামো দেখা যায়, যাকে কলার বলা হয়। এটি মাথা থেকে লেজের দিকে একটি সরু অংশের মতো।
খ) লেজ (Tail):
- অভ্যন্তরীণ কোর (Inner Core): লেজের কেন্দ্রে একটি ফাঁপা নল থাকে, যা কোর নামে পরিচিত। সংক্রমণের সময় এই নলের মাধ্যমেই ভাইরাসের DNA ব্যাকটেরিয়ার কোশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
- আবরণী (Sheath): কোরটি একটি সংকোচনশীল প্রোটিন আবরণী দ্বারা বেষ্টিত থাকে, যাকে শিথ (sheath) বলে। T-ফ্যাজের ক্ষেত্রে, এই শিথটি সংক্রমণের সময় সংকুচিত হতে পারে, যা কোরকে ব্যাকটেরিয়ার কোশ প্রাচীরের মধ্যে প্রবেশ করতে সাহায্য করে অনেকটা সিরিঞ্জের পিস্টনের মতো কাজ করে। শিথটি কতগুলি বলয়াকার প্রোটিন সাবইউনিট দিয়ে গঠিত।
- ভিত্তি প্লেট (Base Plate): লেজের নিম্ন প্রান্তে একটি ষড়ভুজাকার প্লেট থাকে, যাকে ভিত্তি প্লেট বলে। এটি ব্যাকটেরিয়ার কোষ প্রাচীরের সাথে ফ্যাজের প্রথম সংযোগ স্থাপনকারী স্থান।
- লেজের কাঁটা (Tail Pins): ভিত্তি প্লেটের প্রতিটি কোণে ছোট ছোট কাঁটার মতো প্রোটিন গঠন দেখা যায়, যা লেজের কাঁটা নামে পরিচিত। এগুলি ভিত্তি প্লেটকে ব্যাকটেরিয়ার কোশ প্রাচীরের সাথে আরও দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ করতে সাহায্য করে।
- লেজের তন্তু (Tail Fibres): ভিত্তি প্লেটের কোণগুলি থেকে লম্বা, তন্তুর মতো প্রোটিন কাঠামো নির্গত হয়, যাদের লেজের তন্তু বলা হয়। এই তন্তুগুলি ব্যাকটেরিয়ার কোশের পৃষ্ঠে অবস্থিত নির্দিষ্ট রিসেপ্টর অণুকে চিনতে এবং তার সাথে আবদ্ধ হতে ফ্যাজকে সাহায্য করে। পোষক কোশের সাথে সুনির্দিষ্টভাবে আবদ্ধ হওয়ার জন্য লেজের তন্তুগুলির গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা ফ্যাজের পোষক নির্দিষ্টতা (host specificity) নির্ধারণ করে।
মজার তথ্য
ভাইরাসের প্রজনন
ভাইরাসের প্রজনন প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে:
- ফ্যাজিক প্রজনন (Phagic reproduction)
- পিনোসাইটিক প্রজনন (Pinocytic reproduction)
১. ফ্যাজিক প্রজনন
এই প্রকার প্রজনন ব্যাকটেরিওফাজ (Bacteriophages) বা ব্যাকটেরিয়ার ভাইরাসদের মধ্যে দেখা যায়। এটি দুটি চক্রে বিভক্ত:
ক. লাইটিক চক্র (Lytic cycle)
- সংযুক্তি (Attachment): ব্যাকটেরিওফাজ তার লেজের তন্তুগুলির (tail fibers) মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার কোশ প্রাচীরের নির্দিষ্ট রিসেপ্টর সাইটের সাথে আবদ্ধ হয়। এই রিসেপ্টর সাইটগুলি ব্যাকটেরিয়ার জন্য অত্যাবশ্যকীয় প্রোটিন বা কার্বোহাইড্রেট হতে পারে। ফ্যাজের পোষক নির্দিষ্টতা (host specificity) মূলত এই সংযুক্তি প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে।
- প্রবেশ (Penetration): একবার দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হলে, ফ্যাজ তার জেনেটিক উপাদান (DNA) ব্যাকটেরিয়ার কোশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করায়। T-ফ্যাজের ক্ষেত্রে, লেজের শিথ (sheath) সংকুচিত হয় এবং লেজের কোর (core) ব্যাকটেরিয়ার কোশ প্রাচীর এবং কোশ ঝিল্লি ভেদ করে একটি নলের মতো গঠন তৈরি করে। ফ্যাজের DNA তখন এই নলের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার সাইটোপ্লাজমে প্রবেশ করে। ক্যাপসিড (প্রোটিন আবরণ) সাধারণত কোশের বাইরেই থেকে যায়।
- জৈব সংশ্লেষণ (Biosynthesis): ব্যাকটেরিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশের পর ফ্যাজের DNA ব্যাকটেরিয়ার নিজস্ব জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। ব্যাকটেরিয়ার রাইবোজোম, উৎসেচক এবং অন্যান্য কোশীয় উপাদান ব্যবহার করে ফ্যাজের DNA প্রতিলিপি তৈরি করে এবং নতুন ফ্যাজ প্রোটিন (ক্যাপসিড প্রোটিন, লেজের প্রোটিন ইত্যাদি) সংশ্লেষিত হয়। ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিক প্রোটিন এবং নিউক্লিক অ্যাসিড সংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে যায় এবং কোশ সম্পূর্ণরূপে ভাইরাস উৎপাদনে নিয়োজিত হয়।
- সমাবেশ (Assembly): নতুনভাবে সংশ্লেষিত ফ্যাজ DNA এবং প্রোটিন অংশগুলি একত্রিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ ভাইরাস কণা তৈরি করে। মাথার ক্যাপসিডের মধ্যে DNA প্রবেশ করে এবং লেজ, লেজের তন্তু ইত্যাদি অংশগুলি মাথার সাথে যুক্ত হয়। এই প্রক্রিয়াটিকে ভাইরাসের পরিপক্কতাও বলা হয়।
- মুক্তি (Release): পূর্ণাঙ্গ ভাইরাস কণা তৈরি হয়ে গেলে, তারা ব্যাকটেরিয়ার কোশ প্রাচীর ভেঙে (লাইসিস) বাইরে বেরিয়ে আসে। কিছু ফ্যাজ এনজাইম (যেমন লাইসোজাইম) তৈরি করে যা ব্যাকটেরিয়ার কোশ প্রাচীরকে দুর্বল করে এবং অবশেষে তা ফেটে যায়। প্রতিটি সংক্রমিত ব্যাকটেরিয়া কোশ থেকে শত শত নতুন ভাইরাস কণা নির্গত হয়, যা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া কোশকে সংক্রমিত করতে পারে এবং সংক্রমণ ছড়াতে থাকে।
খ. লাইসোজেনিক চক্র (Lysogenic cycle)
লাইসোজেনিক চক্রে ব্যাকটেরিওফাজ ব্যাকটেরিয়ার কোশকে তাৎক্ষণিকভাবে ধ্বংস করে না। বরং, ভাইরাসের DNA ব্যাকটেরিয়ার জিনোমের সাথে একত্রিত হয়ে একটি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এই সুপ্ত ভাইরাস DNA কে প্রোফাজ (prophage) বলা হয়।
• সংযুক্তি ও প্রবেশ (Attachment & Penetration): লাইটিক চক্রের মতোই, ফ্যাজ ব্যাকটেরিয়ার কোশের সাথে সংযুক্ত হয় এবং তার DNA কোশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করায়।• অন্তর্ভুক্তি (Integration): ফ্যাজের DNA ব্যাকটেরিয়ার ক্রোমোজোমের একটি নির্দিষ্ট স্থানে প্রবেশ করে এবং তার সাথে বংশগতভাবে একত্রিত হয়। এই একত্রিত DNA কে প্রোফাজ (prophage) বলা হয়। প্রোফাজ ব্যাকটেরিয়ার জিনোমের একটি অংশে পরিণত হয় এবং ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিক কার্যকলাপের সাথে হস্তক্ষেপ করে না।• কোশ বিভাজন (Cell Division): যখন ব্যাকটেরিয়া কোশ বিভাজিত হয়, তখন ব্যাকটেরিয়ার নিজস্ব DNA-এর সাথে প্রোফাজ DNA-ও প্রতিলিপি তৈরি করে এবং প্রতিটি নতুন অপত্য কোশে (daughter cell) স্থানান্তরিত হয়। এর ফলে, ব্যাকটেরিয়ার প্রতিটি বংশধর কোশে প্রোফাজ সুপ্ত অবস্থায় উপস্থিত থাকে। এই অবস্থায় ব্যাকটেরিয়া কোশটিকে লাইসোজেনিক কোশ (lysogenic cell) বলা হয়।• প্ররোচনা (Induction): কিছু নির্দিষ্ট পরিবেশগত কারণে (যেমন UV বিকিরণ, রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শ), প্রোফাজ সক্রিয় হতে পারে এবং ব্যাকটেরিয়ার ক্রোমোজোম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। একবার বিচ্ছিন্ন হলে, এটি লাইটিক চক্র শুরু করে, যার ফলস্বরূপ নতুন ভাইরাস কণা তৈরি হয় এবং ব্যাকটেরিয়ার কোষ ধ্বংস হয়।উদাহরণ: ল্যাম্বডা ফ্যাজ ভাইরাস
২. পিনোসাইটিক প্রজনন
পিনোসাইটোসিস (Pinocytosis) হলো কোষ কর্তৃক তরল পদার্থ বা ছোট কণা গ্রহণ করার একটি প্রক্রিয়া ("এক প্রকারের phagocytosis")। কিছু ভাইরাস এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পোষক কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং তারপর প্রজনন করে। এই প্রকার প্রজনন প্রধানত প্রাণী এবং উদ্ভিদ ভাইরাসদের মধ্যে দেখা যায়।
- সংযুক্তি (Attachment): ভাইরাস কণা পোষক কোশের কোশ ঝিল্লির নির্দিষ্ট রিসেপ্টর প্রোটিনের সাথে আবদ্ধ হয়।
- প্রবেশ (Entry via Pinocytosis): কোশ ঝিল্লি ভাইরাসের চারপাশে ভাঁজ তৈরি করে একটি ভেসিকল (vesicle) গঠন করে। এই ভেসিকলের অভ্যন্তরে ভাইরাস আবদ্ধ থাকে এবং কোশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। কিছু ভাইরাসের ক্ষেত্রে, কোশ ঝিল্লির সাথে সরাসরি ফিউশনও ঘটতে পারে।
- ক্যাপসিড উন্মোচন (Uncoating): কোশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর, ভাইরাসের ক্যাপসিড ভেঙে যায় এবং তার জেনেটিক উপাদান (DNA বা RNA) মুক্ত হয়।
- জৈব সংশ্লেষণ (Biosynthesis): ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান পোষক কোশের রাইবোজোম, এনজাইম এবং কোশীয় উপাদান ব্যবহার করে নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করে এবং নতুন ভাইরাস প্রোটিন সংশ্লেষিত করে।
- সমাবেশ (Assembly): নতুনভাবে সংশ্লেষিত ভাইরাস DNA বা RNA এবং প্রোটিন অংশগুলি একত্রিত হয়ে নতুন ভাইরাস কণা তৈরি করে।
- মুক্তি (Release): নবগঠিত ভাইরাস কণা বিভিন্ন উপায়ে কোষ থেকে নির্গত হতে পারে। কিছু ভাইরাস কোশের ঝিল্লি ভেদ করে ধীরে ধীরে নির্গত হয় (বাডিং), যেখানে কোশটি তাৎক্ষণিকভাবে ধ্বংস হয় না। অন্যান্য ক্ষেত্রে, ভাইরাসের কারণে কোশের লাইসিস (মৃত্যু এবং বিচ্ছেদ) ঘটতে পারে এবং ভাইরাস কণাগুলি মুক্ত হয়।
উদাহরণ: TMV (টোব্যাকো মোজাইক ভাইরাস), HIV, হেপাটাইটিস বি
মানুষের ভাইরাসজনিত কিছু রোগ ও তাদের কারণকারী ভাইরাস
ক্রমিক | রোগের নাম | কারণকারী ভাইরাস |
---|---|---|
১ | ইনফ্লুয়েঞ্জা | ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস |
২ | স্মলপক্স (গুটিবসন্ত) | ভ্যারিওলা ভাইরাস (Variola virus) |
৩ | মাম্পস (গাল ফোলা) | প্যারামিক্সো ভাইরাস |
৪ | এইডস (AIDS) | রেট্রোভাইরাস (HIV) |
৫ | পোলিওমেলাইটিস | পোলিও ভাইরাস |
৬ | জার্মান মিজলস | রুবেলা ভাইরাস |
৭ | মিজলস(Measles) | মিজলস ভাইরাস |
ইন্টারফেরন (Interferons)
এক ধরনের গ্লাইকোপ্রোটিন যা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত প্রাণীকোশ থেকে নিঃসৃত হয় এবং সুস্থ কোশগুলোকে ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
কিভাবে কাজ করে?
- ভাইরাস আক্রান্ত কোশ থেকে ইন্টারফেরন নিঃসৃত হয়
- পাশের সুস্থ কোশগুলোকে সতর্ক করে এবং প্রতিরোধী করে তোলে
- সুস্থ কোশগুলোতে এমন প্রোটিন তৈরি করে যা ভাইরাসের বৃদ্ধি বাধা দেয়
উদাহরণ:
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত কোশ থেকে নিঃসৃত ইন্টারফেরন পার্শ্ববর্তী কোশগুলোকে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী করে তোলে।
ইন্টারফেরন শরীরের অন্যান্য কোশকে ভাইরাসের হাত থেকে সুরক্ষা দেয় এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে।
সাবভাইরাল এজেন্টস
এগুলি এমন ভাইরাস যাদের একটি অপরিহার্য উপাদান অনুপস্থিত।
১. ভাইরয়েডস (Viroids)
আবিষ্কারক: ডিনার (১৯৭১)
বৈশিষ্ট্য:
- এগুলি সবচেয়ে ছোট স্ব-অনুলিপনকারী কণা
- এগুলি প্রোটিন আবরণহীন সংক্রামক RNA কণা
- এগুলি বাধ্যতামূলক পরজীবী
- এদের RNA শক্তভাবে ভাঁজ হয়ে বৃত্তাকার বা রৈখিক গঠন তৈরি করে
রোগ সৃষ্টি:
শুধুমাত্র উদ্ভিদে প্রায় ২০টি রোগের কারণ, যেমন—
- আলুর স্পিন্ডল টিউবার রোগ (PSTD)
- ক্রিস্যান্থিমাম স্টান্ট
- সাইট্রাস এক্সোকর্টিস
২. ভাইরুসয়েড (Virusoids)
আবিষ্কারক: রেন্ডল ও অন্যান্য
বৈশিষ্ট্য:
- এগুলি RNA ভাইরাস, কিন্তু অন্য বড় ভাইরাসের ক্যাপসিডের ভিতরে থাকে
- এরা পোষক কোষের ভিতরে অনুলিপন করে
- কোনো সংক্রমণ ঘটায় না
৩. প্রিয়নস (Prions)
আবিষ্কারক: আলপার ও অন্যান্য
বৈশিষ্ট্য:
- প্রোটিন দ্বারা গঠিত সংক্রামক কণা (Proteinaceous Infectious Particles)
- এগুলি নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ সৃষ্টি করে
প্রিয়ন দ্বারা সৃষ্ট রোগ:
- কুরু রোগ (Kuru disease বা "হাস্যময় মৃত্যু" রোগ, মানুষের মধ্যে দেখা যায়)
- বোভাইন স্পঞ্জিফর্ম এনসেফালোপ্যাথি (BSE বা "ম্যাড কাউ ডিজিজ", গরুতে দেখা যায়)
- স্ক্র্যাপি রোগ (ভেড়াদের মধ্যে দেখা যায়)
- ক্রুটজফেল্ট-জ্যাকব রোগ (Creutzfeldt-Jakob disease, মানুষের মধ্যে দেখা যায়)
মূল তথ্য: এই সাবভাইরাল এজেন্টগুলি ভাইরাসের চেয়ে সরল গঠনের এবং বিভিন্ন গুরুতর রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম।