লাইকেন (Lichen) হলো একটি দ্বৈত (বা যৌগিক) জীব বা সত্তা, যা একটি ছত্রাক সঙ্গী (মাইকোবায়োন্ট) এবং একটি শৈবাল সঙ্গী (ফাইকোবায়োন্ট) -এর স্থায়ী সহাবস্থানের ফলে গঠিত হয়।
এই সহাবস্থানে ছত্রাক বা মাইকোবায়োন্ট অংশটিই প্রধান ভূমিকা পালন করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ছত্রাক সঙ্গী অ্যাসকোমাইসিটিস (Ascomycetes) শ্রেণীর অন্তর্গত হয়, এবং এদের অ্যাসকোলাইকেন (Ascolichens) বলা হয় (উদাহরণস্বরূপ - গ্রাফিস, ক্ল্যাডোনিয়া, পারমেলিয়া, উসনিয়া ইত্যাদি)।
কিছু ক্ষেত্রে ছত্রাক সঙ্গীটি ব্যাসিডিওমাইসিটিস (Basidiomycetes) শ্রেণীরও হতে পারে, যাদের ব্যাসিডিওলাইকেন (Basidiolichens) বলা হয় (উদাহরণস্বরূপ - কোরেল্লা, কোরা ইত্যাদি)।
ফাইকোবায়োন্ট বা শৈবাল অংশটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্লোরোফাইসি (Chlorophyceae) শ্রেণীর শৈবাল হয় (উদাহরণস্বরূপ - ক্লোরেল্লা, ট্রেবোক্সিয়া, প্রোটোকক্কাস, পালমেলা ইত্যাদি)। অথবা এটি একটি নীলাভ-সবুজ শৈবাল (BGA) বা সায়ানোব্যাকটেরিয়াও হতে পারে (উদাহরণস্বরূপ - নস্টক, ক্লোরোকক্কাস, সাইটোনেমা ইত্যাদি)।
'লাইকেন' (Lichen) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন থিওফ্রাস্টাস (Theophrastus) (জীবনকাল আনুমানিক ৩৭০-২৮৫ খ্রিস্টপূর্ব), যাঁকে উদ্ভিদবিদ্যার জনকও বলা হয়।
লাইকেন সাধারণত আর্দ্র এবং খোলা পরিবেশে বাস করে, কিন্তু তারা চরম শুষ্কতা সহ্য করতে পারে।
যাইহোক, লাইকেন বায়ু দূষণ, বিশেষ করে সালফার অক্সাইড (SO₂) এর কারণে দূষণ সহ্য করতে পারে না। এ কারণে এগুলিকে SO₂ দূষণের সূচক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
লাইকেন বহুবর্ষজীবী (দীর্ঘস্থায়ী)। এদের বৃদ্ধি ধীরগতির। লাইকেনের রং ধূসর, হলদেটে, সবুজেটে, কমলা, গাঢ় বাদামি বা কালচে হতে পারে।
লাইকেনের বাসস্থান
লাইকেন প্রায়শই আর্দ্র (ভেজা), কিন্তু প্রতিকূল এবং জনবসতিহীন বা বসবাসের অযোগ্য জায়গায় জন্মায়।
এই স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে:
- অনুর্বর শিলা বা নগ্ন পাথর (এদের স্যাক্সিকোলস বা পাথরবাসী লাইকেন বলে)
- মাটি (এদের টেরিকোলস বা ভূমিবাসী লাইকেন বলে)
- বরফে ঢাকা তুন্দ্রা অঞ্চল বা আল্পাইন (উচ্চ পার্বত্য) অঞ্চল
- বালিয়াড়ি
- বাড়ির ছাদ
- দেওয়াল
- কাঠ (এদের লিগ্নিকোলস বা কাষ্ঠবাসী লাইকেন বলে)
- গাছের ছাল বা বাকল (এদের কর্টিকোলস বা বল্কবাসী লাইকেন বলে)
- পাতা, ইত্যাদি।
লাইকেনের উপাদান: মাইকোবায়ন্ট ও ফাইকোবায়ন্ট
লাইকেন প্রকৃতপক্ষে ছত্রাক ও শৈবালের একটি সমবায়িক সম্পর্ক (সিম্বায়োসিস)
লাইকেনে ফাইকোবায়ন্টের অবস্থান
লাইকেনের গঠনে ফাইকোবায়ন্ট নিম্নলিখিত অংশে থাকে:
এই ছত্রাক + শৈবাল সমবায় (সিম্বায়োসিস) লাইকেনকে একটি অনন্য জীব হিসেবে টিকে থাকতে সাহায্য করে
লাইকেনের গঠন (Structure of Lichens)
বাহ্যিক আকৃতি (Morphology) অনুযায়ী, লাইকেন তিন প্রকার:
১. ক্রাস্টোস (Crustose)
- ক্রাস্ট বা খোসার মতো দেখতে।
- স্তর (substratum) এর সঙ্গে লেগে থাকে এবং একাধিক স্থানে আটকে থাকে।
- উদাহরণ: Graphis, Lecanora, Rhizocarpon।
২. ফোলিওস (Foliose)
- লাইকেনের দেহ চ্যাপ্টা, প্রশস্ত, লোবযুক্ত এবং পাতার মতো।
- এক বা কয়েকটি স্থানে রাইজয়েড-জাতীয় গঠন (রাইজাইন) দ্বারা স্তরের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
- উদাহরণ: Parmelia, Peltigera।
৩. ফ্রুটিকোস (Fruticose)
- গুল্মের মতো শাখান্বিত।
- একটি ডিস্কের মাধ্যমে স্তরের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
- উদাহরণ: Cladonia, Usnea, Evernia, Bryonia।
লাইকেনের বংশবৃদ্ধির পদ্ধতি
লাইকেন প্রধানত চারটি পদ্ধতিতে বংশবৃদ্ধি করে:
১ ক্রমবর্ধমান মৃত্যু এবং পচন (Progressive death and decay)
এই পদ্ধতিতে লাইকেনের পুরনো এবং ভেতরের অংশ ধীরে ধীরে মারা যায় এবং পচন ধরে। এই পচনশীল অংশটি অবশেষে মূল থ্যালাস (Thallus - লাইকেনের দেহ) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদি এই বিচ্ছিন্ন অংশটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ছত্রাক এবং শৈবাল কোষ থাকে এবং এটি উপযুক্ত পরিবেশে পতিত হয়, তবে এটি একটি নতুন লাইকেন থ্যালাসের জন্ম দিতে পারে।
তবে, এটি বংশবৃদ্ধির একটি খুব কার্যকর পদ্ধতি নয় কারণ বিচ্ছিন্ন অংশে কার্যকর সংখ্যক শৈবাল এবং ছত্রাক কোষের উপস্থিতি নিশ্চিত নয়।
২ খণ্ডন (Fragmentation)
খণ্ডন হলো লাইকেনের থ্যালাসের ছোট ছোট অংশে ভেঙে যাওয়া। এই ভাঙন বিভিন্ন কারণে হতে পারে:
- শারীরিক আঘাত (Physical damage): বাতাস, বৃষ্টি, পশুচারণ বা অন্য কোনো কারণে লাইকেনের থ্যালাস ভেঙে যেতে পারে।
- শুকিয়ে যাওয়া এবং পুনরায় আর্দ্র হওয়া (Drying and rehydration): বারবার শুষ্ক এবং আর্দ্র হওয়ার কারণে থ্যালাসে দুর্বল স্থান তৈরি হতে পারে এবং তা ভেঙে যেতে পারে।
যদি এই খণ্ডিত অংশের মধ্যে ছত্রাক এবং শৈবাল উভয় উপাদানই জীবিত থাকে এবং এটি একটি নতুন উপযুক্ত স্থানে পৌঁছাতে পারে, তবে এটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে একটি নতুন সম্পূর্ণ লাইকেনের জন্ম দিতে পারে।
৩ আইসিডিয়া (Isidia)
আইসিডিয়া হলো থ্যালাসের উপরের দিকে ছোট ছোট আঙুলের মতো বা সিলিন্ডারের মতো অভিক্ষেপ। এগুলোর মধ্যে কর্টেক্স (ছত্রাকের বাইরের স্তর), মেডুলা (ছত্রাকের ভেতরের স্তর) এবং কিছু শৈবাল কোষ থাকে। আইসিডিয়া সহজেই ভেঙে মূল থ্যালাস থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারে।
বাতাসের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে এরা নতুন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং উপযুক্ত পরিবেশে নতুন লাইকেনের জন্ম দেয়। আইসিডিয়া সাধারণত থ্যালাসের পৃষ্ঠের উপর ঘনভাবে গঠিত হয় এবং এদের আকার ও আকৃতি বিভিন্ন লাইকেনের প্রজাতিতে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।
৪ সোরেডিয়া (Soredia)
এই পদ্ধতিটি অযৌন প্রজননের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। সোরেডিয়া হলো অতি ক্ষুদ্র লাইকেন প্রোপাগিউলস (lichen propagules) (বংশবিস্তারকারী একক) যা sori (soredia ধারণকারী অঙ্গ) নামক গুটির ভিতরে প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়।
উৎপত্তি ও গঠন (Production and Structure):
সোরেডিয়া মূলত কয়েকটি শৈবাল কোশের চারপাশে ছত্রাকের হাইফির (সূক্ষ্ম তন্তু) একটি আলগা জালিকা দ্বারা গঠিত। এর মধ্যে কোনো কর্টিক্যাল স্তর থাকে না, তাই এরা খুব সহজেই পরিবেশের সংস্পর্শে আসে।
বিস্তার (Dispersal):
সোরেডিয়া বাতাসের স্রোতের মাধ্যমে খুব সহজে এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। হালকা হওয়ায় এরা দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করতে সক্ষম।
নতুন লাইকেনের জন্ম (New Lichen Formation):
যখন কোনো সোরেডিয়া একটি উপযুক্ত সাবস্ট্রেটামের (পৃষ্ঠ) উপর পতিত হয়, যেখানে পর্যাপ্ত আলো, আর্দ্রতা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান থাকে, তখন প্রতিটি সোরেডিয়াম একটি নতুন লাইকেনের থ্যালাসের জন্ম দিতে পারে। যেহেতু একটি সোরেডিয়ামের মধ্যে ইতিমধ্যেই ছত্রাক এবং শৈবাল উভয় অংশই উপস্থিত থাকে, তাই নতুন লাইকেন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
এই চারটি পদ্ধতির মাধ্যমে লাইকেন প্রকৃতিতে নিজেদের বিস্তার ঘটায় এবং বংশবৃদ্ধি করে
লাইকেনের থ্যালাসে উপস্থিত বিশেষ গঠন
লাইকেনের থ্যালাসে কিছু বিশেষ গঠন দেখা যায় যা বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলী সম্পাদনে সাহায্য করে
১ সাইফেলাই (Cyphellae)
কাজ
সাইফেলাই মূলত গ্যাসের আদান-প্রদানে সাহায্য করে। থ্যালাসের অভ্যন্তরে অক্সিজেন প্রবেশ এবং কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের জন্য এটি একটি পথ তৈরি করে।
অবস্থান
এটি থ্যালাসের নিম্ন কর্টেক্সে (lower cortex) অর্থাৎ নীচের স্তরে উপস্থিত থাকে। সাইফেলাই দেখতে ছোট ছোট কাপের মতো বা গর্তের মতো গঠনযুক্ত হতে পারে। এই গঠন থ্যালাসের ভেতরের বায়ু চলাচলের জন্য একটি বিশেষ স্থান তৈরি করে।
"গ্যাস বিনিময়ের জন্য বিশেষায়িত গঠন"
২ সেফালোডিয়া (Cephalodia)
কাজ
- আর্দ্রতা ধরে রাখা: এর গঠন জল ধরে রাখতে সাহায্য করতে পারে, যা লাইকেনের শুষ্ক পরিবেশে টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- নাইট্রোজেন স্থিতিকরণ: কিছু লাইকেনে সেফালোডিয়ার মধ্যে সায়ানোব্যাকটেরিয়া (নীলচে সবুজ শৈবাল) নামক একটি বিশেষ প্রকার শৈবাল অংশীদার হিসেবে থাকে। এই সায়ানোব্যাকটেরিয়া বাতাস থেকে সরাসরি নাইট্রোজেন গ্রহণ করে জৈব যৌগে রূপান্তরিত করতে পারে, যা লাইকেনের পুষ্টির জন্য অপরিহার্য।
বিশেষ তথ্য
লাইকেনের প্রধান শৈবাল অংশীদার সাধারণত সবুজ শৈবাল হয়, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে সায়ানোব্যাকটেরিয়াও উপস্থিত থাকতে পারে এবং এরা মূলত সেফালোডিয়ার মধ্যেই অবস্থান করে।
নাইট্রোজেন স্থিতিকরণের ক্ষমতা লাইকেনকে পুষ্টি-দরিদ্র পরিবেশে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে
৩ শ্বাসছিদ্র (Breathing pores)
কাজ
শ্বাসছিদ্রগুলি বায়ু চলাচলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি থ্যালাসের অভ্যন্তরে বাতাস প্রবেশ করতে এবং বের হতে সাহায্য করে, যা সালোকসংশ্লেষ এবং শ্বসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার জন্য অপরিহার্য।
অবস্থান
এই ছিদ্রগুলি থ্যালাসের উপরের কর্টেক্সে (upper cortex) অর্থাৎ বাইরের স্তরে অবস্থিত থাকে। শ্বাসছিদ্রের গঠন বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে এবং এটি গ্যাসের আদান-প্রদানকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
"প্রাকৃতিক শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে"
এই বিশেষ গঠনসমূহ লাইকেনকে বিভিন্ন পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে এবং কার্যকরভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে
লাইকেন: প্রকৃতির আদি উপনিবেশ স্থাপনকারী
লাইকেনকে প্রায়শই অনুর্বর শিলা, খাড়া পাহাড়, পর্বত এবং নতুন ভূখণ্ডে আদি বা অগ্রণী উপনিবেশ স্থাপনকারী হিসেবে গণ্য করা হয়
অন্যান্য অনেক উদ্ভিদের তুলনায় লাইকেন প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে এবং বৃদ্ধি পেতে সক্ষম। তাদের এই বিশেষ ক্ষমতা প্রকৃতিতে প্রথম বসতি স্থাপনের জন্য আদর্শ করে তোলে।
লাইকেনের আদি উপনিবেশ স্থাপনকারী হিসেবে ভূমিকার কারণ
১. অনুর্বর স্থানে টিকে থাকার ক্ষমতা
লাইকেন এমন স্থানেও জন্মাতে পারে যেখানে অন্য কোনো উদ্ভিদ সহজে বাঁচতে পারে না। পাথরের উপর সামান্য আর্দ্রতা এবং সূর্যালোক পেলেই এরা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
২. অ্যাসিড নিঃসরণ
লাইকেন জৈব অ্যাসিড নিঃসরণ করে যা পাথরের রাসায়নিক ক্ষয় ঘটায়। এর ফলে পাথরের উপরিভাগে ছোট ছোট ফাটল বা খাঁজ তৈরি হয়, যা অন্যান্য জীবের জন্য পথ প্রস্তুত করে।
৩. জৈব পদার্থের সঞ্চয়
পাথরের ক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট ফাটল এবং লাইকেনের মৃত অংশ একত্রিত হয়ে জৈব পদার্থের সৃষ্টি করে। সময়ের সাথে সাথে এই স্তর বৃদ্ধি পায় এবং মাটি গঠনের প্রাথমিক স্তর তৈরি করে।
৪. মস বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করা
লাইকেনের কার্যকলাপের ফলে সৃষ্ট পরিবেশ মসের বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত হয়। মস আরও বেশি জৈব পদার্থ জমা করে, যা পরবর্তীতে বৃহত্তর উদ্ভিদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।
প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ধারা (Ecological Succession)
লাইকেনের মাধ্যমে শুরু হয় একটি ধারাবাহিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যা পরিবেশকে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত করে:
- লাইকেন পাথরের উপর প্রথম বসতি স্থাপন করে
- পাথরের ক্ষয় ঘটিয়ে প্রাথমিক মাটি তৈরি করে
- মস এবং অন্যান্য ছোট উদ্ভিদের জন্য পথ তৈরি করে
- অবশেষে বৃহত্তর উদ্ভিদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে
লাইকেন → মস → ঘাস → গুল্ম → বৃক্ষ
প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা
পরিবেশগত গুরুত্ব
লাইকেনের এই আদি উপনিবেশ স্থাপনকারী ভূমিকা প্রকৃতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ:
- অনুর্বর পাথুরে এলাকায় জীবনধারনের সূচনা করে
- মাটি গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে
- অন্যান্য জীবের জন্য বসবাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করে
- পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে
লাইকেন প্রকৃতির অগ্রদূত, যারা অনুর্বর ভূমিকে জীবনধারনের উপযোগী করে তোলে
লাইকেনের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার
লাইকেন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে শীতল ও প্রতিকূল পরিবেশে
অন্যান্য উদ্ভিদের অভাবে লাইকেন অনেক সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে আর্কটিক, মরুভূমি এবং পর্বতাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষেরা শতাব্দী ধরে লাইকেনকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
১. ক্ল্যাডোনিয়া র্যাঞ্জিফেরা (Cladonia rangifera)
"রেনডিয়ার মস"
- আর্কটিক ও উত্তরাঞ্চলের টুন্দ্রা অঞ্চলে পাওয়া যায়
- রেনডিয়ার, ক্যারিবু ও মস্কের প্রধান খাদ্য
- শীতকালে প্রাণীদের বেঁচে থাকতে সহায়তা করে
২. সেট্রেরিয়া আইসল্যান্ডিকা (Cetraria islandica)
"আইসল্যান্ড মস"
- আইসল্যান্ড, সুইডেন ও নরওয়েতে জনপ্রিয়
- শুকিয়ে গুঁড়ো করে ব্যবহার করা হয়
- স্যুপ, রুটি ও পোরিজে ব্যবহৃত হয়
৩. লেকানোরা এসকুলেন্টা (Lecanora esculenta)
"যিহুদীদের মরুভূমির রুটি"
- ঐতিহাসিকভাবে মরুভূমিতে ব্যবহৃত হত
- শুকিয়ে গুঁড়ো করে রুটি বানানো হত
- অসুবিধাজনক পরিবেশে খাদ্য নিরাপত্তা প্রদান করত
৪. পারমেলিয়া (Parmelia)
"রক ফ্লাওয়ার"
- কিছু সংস্কৃতিতে বিলাসবহুল খাদ্য
- শুকিয়ে বা রান্না করে খাওয়া হয়
- বিশেষ অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়
৫. ডার্মাটোকার্পন মিনিয়াটাম (Dermatocarpon miniatum)
"স্টোন মাশরুম" বা "পাথরের মাশরুম"
- জাপানে একটি জনপ্রিয় সবজি
- স্যুপ ও স্ট্যুতে ব্যবহৃত হয়
- অনন্য স্বাদের জন্য মূল্যবান
- পাথরের উপর জন্মায় বলে এরকম নাম
লাইকেনের ব্যবহার: একটি সংক্ষিপ্ত সারাংশ
লাইকেনের ব্যবহার ও পরিবেশগত ভূমিকা
১ ঔষধি গুণ (Medicinal Uses)
ইউসনিক অ্যাসিড (Usnic Acid)
- উৎস: Usnea (পুরানো মানুষের দাড়ি/Old Man's Beard) এবং Cladonia প্রজাতির লাইকেন
- গুণাগুণ: প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক হিসাবে কাজ করে, ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস বিরোধী
- ব্যবহার: পোড়া ও ক্ষতের মলম তৈরিতে (স্কিন ক্রিম ও অ্যান্টিসেপটিক প্রস্তুতি)
প্রাচীন চিকিৎসা
সেল্টিক ও নর্স সংস্কৃতিতে ক্ষত নিরাময়ে ব্যবহৃত
আধুনিক ব্যবহার
অ্যান্টিবায়োটিক ক্রিম ও টুথপেস্টে যোগ করা হয়
২ বায়ু দূষণের সূচক (Air Pollution Indicator)
সংবেদনশীলতা
লাইকেন সালফার ডাইঅক্সাইড (SO₂) এর প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। কোনো অঞ্চলে লাইকেনের সংখ্যা কমে গেলে তা SO₂ দূষণের স্পষ্ট লক্ষণ।
ব্যবহার
লাইকেনকে "প্রাকৃতিক বায়ু দূষণ মাপকাঠি" হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞানীরা লাইকেনের উপস্থিতি ও প্রাচুর্য দেখে বায়ুর গুণমান নির্ধারণ করেন।
"লাইকেনের অনুপস্থিতি শহুরে ও শিল্পাঞ্চলে বায়ু দূষণের স্পষ্ট সূচক"
৩ অগ্নিকাণ্ডের কারণ (Role in Forest Fires)
Usnea প্রজাতির বৈশিষ্ট্য
Usnea প্রজাতির লাইকেন শুষ্ক আবহাওয়ায় অত্যন্ত জ্বলনযোগ্য। গরমকালে এগুলি শুকিয়ে গেলে বন অগ্নিকাণ্ডের কারণ হতে পারে।
বিপদের ক্ষেত্র
বিশেষ করে শঙ্কুধান বনে (কনিফেরাস বন) এই লাইকেন বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের কারণ হতে পারে।
"শুষ্ক Usnea লাইকেন বনের জন্য 'প্রাকৃতিক কাইন্ডলিং' হিসেবে কাজ করে"
লাইকেনের এই বৈচিত্র্যময় ভূমিকা প্রকৃতিতে তাদের গুরুত্বকে আরও বৃদ্ধি করে