Biological Classification / শ্রেণীবিন্যাস

 জৈবিক শ্রেণীবিন্যাস (Biological Classification) হল জীবদের তাদের সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত করার এবং এই গোষ্ঠীগুলিকে একটি শ্রেণিবিন্যাসক্রম (hierarchy of categories) এ সাজানোর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।

সময়ের সাথে সাথে, একটি শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে যা শুধুমাত্র আকৃতিগত (morphological), শারীরবৃত্তীয় (physiological) এবং প্রজননগত (reproductive) সাদৃশ্যই নয়, বরং ফাইলোজেনেটিক (phylogenetic) বা বিবর্তনীয় সম্পর্ককেও প্রতিফলিত করে। এর অর্থ হল, এই শ্রেণীবিন্যাস জীবদের মধ্যে বিবর্তনীয় ইতিহাস এবং তাদের সাধারণ পূর্বপুরুষের ভিত্তিতে তাদের সম্পর্ককে বিবেচনা করে।

বংশগতিগত সম্পর্ক (Phylogenetic): জীবের পূর্বপুরুষদের সাথে সম্পর্ক, অর্থাৎ বিবর্তনীয় ইতিহাস।


শ্রেণীবিন্যাসের রাজ্য পদ্ধতি (Kingdom Systems of Classification):


জীবজগতকে শ্রেণীবদ্ধ করার প্রাচীন পদ্ধতিগুলি সরল ছিল এবং এগুলি সাধারণত এক বা দুটি বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হতো। সময়ের সাথে সাথে, এই পদ্ধতিগুলি আরও উন্নত এবং বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠেছে।

এরিস্টটলের শ্রেণীবিন্যাস:

জীবজগতকে শ্রেণীবদ্ধ করার প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা করেছিলেন এরিস্টটল (Aristotle)। তিনি জীবদের তাদের বাসস্থান এবং শারীরিক বৈশিষ্ট্য (যেমন গাছ বা প্রাণী) এর উপর ভিত্তি করে শ্রেণীবদ্ধ করেছিলেন। এরিস্টটল জীবজগতকে প্রধান দুটি ভাগে বিভক্ত করেছিলেন:

১. উদ্ভিদজগত (Plants) :-

তিনি উদ্ভিদদের তাদের আকৃতি এবং বৃদ্ধির ধরনের উপর ভিত্তি করে তিনটি প্রধান বিভাগে শ্রেণীবদ্ধ করেছিলেন:

ঘাস (Herbs): ছোট এবং নরম কাণ্ডযুক্ত উদ্ভিদ।

গুল্ম (Shrubs): মাঝারি আকারের কাষ্ঠল উদ্ভিদ।

গাছ (Trees): বড় এবং শক্ত কাণ্ডযুক্ত উদ্ভিদ।

২. প্রাণীজগত (Animals) :-

তিনি প্রাণীদের রক্তের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি এর ভিত্তিতে দুটি প্রধান বিভাগে শ্রেণীবদ্ধ করেছিলেন :

অ্যানাইমা (Anaima): যেসব প্রাণীর শরীরে লাল রক্তকণিকা (RBC) নেই। উদাহরণ: পোকামাকড়, মোলাস্কা ইত্যাদি।

ইনাইমা (Enaima): যেসব প্রাণীর শরীরে লাল রক্তকণিকা (RBC) আছে। উদাহরণ: স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ ইত্যাদি।



কিছু জীব যেমন ক্ল্যামাইডোমোনাস (Chlamydomonas), ইউগ্লিনা (Euglena), এবং স্লাইম মোল্ডস (Slime Moulds) এমন বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে যা উদ্ভিদ এবং প্রাণী উভয় রাজ্যের বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে যায়। এই ধরনের জীবগুলি উদ্ভিদ বা প্রাণী রাজ্যে স্বাভাবিকভাবে ফেলা যায় না, তাই তাদের জন্য একটি নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছিল। 


তিন রাজ্য শ্রেণীবিন্যাস (Three Kingdom Classification):

জীবজগতের শ্রেণীবিন্যাসে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসেন আর্নস্ট হেকেল (Ernst Haeckel)। তিনি প্রস্তাব করেন যে, প্রোটিস্টা (Protista) নামে একটি তৃতীয় রাজ্য তৈরি করা উচিত, যেখানে সমস্ত এককোশী অণুজীব (Unicellular Microorganisms)-কে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই প্রোটিস্টা রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের এককোশী, প্রধানত জলজ ইউক্যারিওটিক জীবদের রাখা হয়।


হেকেলের তিন রাজ্য শ্রেণীবিন্যাস নিম্নরূপ:

১. প্লান্টি (Plantae): সবুজ উদ্ভিদ এবং বহুকোশী শৈবাল।

২. অ্যানিমালিয়া (Animalia): বহুকোশী প্রাণী।

৩. প্রোটিস্টা (Protista): সমস্ত এককোষী ইউক্যারিওটিক জীব এবং কিছু অণুজীব। এই রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের জীব রয়েছে, যেমন:

   • ছত্রাক (Fungi): কিছু এককোশী ছত্রাক।

   • প্রোটোজোয়া (Protozoa): এককোশী প্রাণীসদৃশ জীব, যেমন অ্যামিবা, প্যারামিসিয়াম।

   • শৈবাল (Algae): এককোষী শৈবাল, যেমন ক্ল্যামাইডোমোনাস।

   • ব্যাকটেরিয়া (Bacteria): যদিও ব্যাকটেরিয়া প্রোক্যারিওটিক, হেকেল প্রাথমিকভাবে এদেরও প্রোটিস্টা রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

   • স্লাইম মোল্ডস (Slime Moulds): উদ্ভিদ এবং প্রাণী উভয়ের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে।


চার রাজ্য শ্রেণীবিন্যাস (Four Kingdom Classification):

হার্বার্ট কোপেল্যান্ড (Herbert Copeland) জীবজগতের শ্রেণীবিন্যাসে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেন। তিনি মনেরা (Monera) নামে একটি চতুর্থ রাজ্য প্রস্তাব করেন, যেখানে সমস্ত প্রোক্যারিওটিক জীব (Prokaryotic Organisms)-কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই শ্রেণীবিন্যাস জীবজগতের বৈচিত্র্য এবং জটিলতাকে আরও ভালভাবে প্রতিফলিত করে। 


মনেরা রাজ্য দুটি প্রধান গ্রুপে বিভক্ত:

ইউব্যাকটেরিয়া (Eubacteria): সাধারণ ব্যাকটেরিয়া, যেগুলি প্রায় সব পরিবেশে পাওয়া যায়। সায়ানোব্যাকটেরিয়া (Cyanobacteria) বা নীল-সবুজ শৈবাল এরা প্রোক্যারিওটিক এবং সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করে।

আর্কিয়াব্যাকটেরিয়া (Archaebacteria): এই ব্যাকটেরিয়া অত্যন্ত চরম পরিবেশে (যেমন গরম জলপ্রপাত, লবণাক্ত জল) বাস করতে পারে।



পাঁচ রাজ্য শ্রেণীবিন্যাস (Five Kingdom Classification) :

১৯৬৯ সালে আর. এইচ. হুইটেকার (R.H. Whittaker) জীবজগতকে পাঁচটি রাজ্যে বিভক্ত করার একটি নতুন শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি প্রস্তাব করেন। এই পদ্ধতিতে জীবদের কোশের গঠন, দেহের সংগঠন, পুষ্টির পদ্ধতি, প্রজনন এবং বিবর্তনীয় সম্পর্ক-এর ভিত্তিতে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। এই শ্রেণীবিন্যাস জীবজগতের বৈচিত্র্য এবং জটিলতাকে আরও ভালভাবে প্রতিফলিত করে।

পাঁচ রাজ্য শ্রেণীবিন্যাসের মানদণ্ড (Criteria):

হুইটেকার নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলির ভিত্তিতে জীবজগতকে পাঁচটি রাজ্যে বিভক্ত করেছিলেন:

1. কোশের গঠন (Cell Structure):

     • প্রোক্যারিওটিক (Prokaryotic): কোশে সুগঠিত নিউক্লিয়াস বা কোশ অঙ্গাণু নেই (যেমন ব্যাকটেরিয়া)।

     • ইউক্যারিওটিক (Eukaryotic): কোশে সুগঠিত নিউক্লিয়াস এবং কোশ অঙ্গাণু রয়েছে (যেমন প্রোটিস্টা, ছত্রাক, উদ্ভিদ, প্রাণী)।

2. দেহের সংগঠন (Thallus Organisation):

     • অবিভক্ত দেহ (Undifferentiated): দেহ সরল এবং বিভক্ত নয় (যেমন ব্যাকটেরিয়া, কিছু শৈবাল)।

     • বিভক্ত দেহ (Differentiated): দেহ জটিল এবং টিস্যু বা অঙ্গে বিভক্ত (যেমন উদ্ভিদ, প্রাণী)।

3. পুষ্টির পদ্ধতি (Mode of Nutrition) :

     • স্বপোষী (Autotrophic): সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে নিজের খাদ্য তৈরি করে (যেমন উদ্ভিদ, কিছু শৈবাল)।

     • পরপোষী (Heterotrophic): অন্য জীব বা জৈব পদার্থ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে (যেমন প্রাণী, ছত্রাক, কিছু প্রোটিস্টা)।

4. প্রজনন (Reproduction):

    • অযৌন (Asexual) বা যৌন (Sexual) প্রজননের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে।

5. বিবর্তনীয় সম্পর্ক (Phylogenetic Relationship):

   • জীবদের মধ্যে বিবর্তনীয় ইতিহাস এবং সাধারণ পূর্বপুরুষের ভিত্তিতে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়।


পাঁচ রাজ্য শ্রেণীবিন্যাসের কাঠামো:-

হুইটেকারের পাঁচ রাজ্য শ্রেণীবিন্যাস নিম্নরূপ:

1. মনেরা (Monera):

   - সমস্ত প্রোক্যারিওটিক জীব, যেমন ব্যাকটেরিয়া এবং সায়ানোব্যাকটেরিয়া (নীল-সবুজ শৈবাল)।

   - কোশে সুগঠিত নিউক্লিয়াস বা কোশ অঙ্গাণু নেই।

   - উদাহরণ: ই. কোলাই, সালমোনেল্লা।

2. প্রোটিস্টা (Protista):

   - এককোশী ইউক্যারিওটিক জীব।

   - প্রধানত জলজ পরিবেশে বাস করে।

   - উদাহরণ: অ্যামিবা, প্যারামিসিয়াম, ইউগ্লিনা, ক্ল্যামাইডোমোনাস।

3. ফাঙ্গি (Fungi):

   - বহুকোশী বা এককোশী ইউক্যারিওটিক জীব।

   - পরপোষী পুষ্টির পদ্ধতি (জৈব পদার্থ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে)।

   - উদাহরণ: ইস্ট, মাশরুম, ছত্রাক।

4. প্লান্টি (Plantae):

   - বহুকোশী ইউক্যারিওটিক জীব।

   - স্বপোষী পুষ্টির পদ্ধতি (সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করে)।

   - উদাহরণ: গাছ

5. অ্যানিমালিয়া (Animalia):

   - বহুকোষী ইউক্যারিওটিক জীব।

   - পরপোষী পুষ্টির পদ্ধতি (অন্য জীব বা জৈব পদার্থ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে)।

   - উদাহরণ: মানুষ, পাখি, মাছ, পোকামাকড়।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন