যকৃত (Liver) :-
• যকৃত এন্ডোডার্ম (Endoderm) থেকে তৈরি হয়।
• এর ওজন প্রায় ১.৫ কেজি।
• এটি ডান পাশের উদরের গহ্বরে অবস্থিত।
• এটি শরীরের সবচেয়ে বড় গ্রন্থি।
• যকৃত ডান ও বাম খণ্ড নিয়ে গঠিত।
• বাম খণ্ড ডান খণ্ডের চেয়ে ছোট।
• ফ্যালসিফর্ম লিগামেন্ট (Falciform ligament) দ্বারা ডান ও বাম যকৃতের খণ্ড পৃথক থাকে।
• ডান ও বাম যকৃত খণ্ড থেকে ডান ও বাম হেপাটিক নালী (Right and Left Hepatic Duct) নির্গত হয়।
• এই দুই নালী মিলিত হয়ে কমন হেপাটিক ডাক্ট (Common Hepatic Duct) গঠন করে।
পিত্তথলি (Gallbladder):
• পিত্তথলি যকৃতের ডান খণ্ডের নিচে অবস্থিত।
• এটি পিত্তরস ঘন করার জন্য দায়ী।
• সিস্টিক নালী (Cystic duct) হলো পিত্তথলির নালী।
• পিত্তথলির অভ্যন্তরীণ দেয়ালে থাকা মাইক্রোভিলাই (Microvilli) পিত্তরস থেকে আর্দ্রতা শোষণ করে। ফলে পিত্ত রস ঘন হয়।
∆ সিস্টিক নালী (Cystic duct) কমন হেপাটিক নালীর (Common hepatic duct) সঙ্গে যুক্ত হয়ে কমন বাইল ডাক্ট (Ductus choledocus) গঠন করে।
যকৃতের গঠন:
• যকৃত অসংখ্য বহুকৌণিক লোবিউলস (Polygonal lobules) দিয়ে গঠিত। যাকে হেপাটিক লোবিউল বলে। এটি যকৃতের গঠনগত একক।
• প্রতিটি লোবিউল একটি আবরণ দ্বারা আবৃত, যাকে গ্লিসনস ক্যাপসুল (Glisson's capsule) বলা হয়। এটি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের একটি বৈশিষ্ট্য।
• প্রতিটি লোবিউল রেডিয়াল ভাবে সাজানো হেপাটিক কোষের সারি (Hepatic cells বা Hepatocytes) নিয়ে গঠিত, যাকে হেপাটিক কর্ড (Hepatic cord) বলা হয়।
• প্রতিটি হেপাটিক কর্ড সাধারণত দুই কোশ পুরু হয়।
• হেপাটিক কর্ডের মধ্যবর্তী স্থানে একটি ফাঁকা জায়গা থাকে, যাকে হেপাটিক সাইনুসয়েড (Hepatic sinusoid) বলা হয়।
• এই ফাঁকা স্থানে রক্ত পূর্ণ থাকে। এই রক্তের মধ্যে লোহিত রক্ত কণিকা (WBC) উপস্থিত থাকে, যাদের কুফার কোশ (Kupffer cells) বলা হয়। কুফার কোশ রক্তের ক্ষতিকারক পদার্থগুলো পরিষ্কার করার কাজ করে।
• হেপাটোসাইটস (Hepatocytes) বা যকৃত কোশের সারির মধ্যবর্তী স্থানে একটি নালির মতো গঠন থাকে, যাকে বাইল ক্যানালিকুলি বলা হয়।
• হেপাটোসাইটস কোশ পিত্তরস উৎপন্ন করে এবং তা বাইল ক্যানালিকুলিতে প্রবেশ করায়। এটি বাইল (পিত্তরস) বহন করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
• বাইল ক্যানালিকুলি পরে পোর্টাল ট্রায়াডে (Portal triad) এসে মিশে যায়।
পোর্টাল ট্রায়াড (Portal Triad) : পোর্টাল ট্রায়াড হলো যকৃতের লোবিউলগুলোর কোণায় অবস্থিত তিনটি মুখ বা ছিদ্রের সমন্বয়। এটি যকৃতের রক্ত সরবরাহ এবং পিত্তরস পরিবহনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
পোর্টাল ট্রায়াডের গঠন :
1. হেপাটিক পোর্টাল ভেইনের ছিদ্র (Opening of Hepatic Portal Vein) : এই ছিদ্রের মাধ্যমে অন্ত্র থেকে সংগ্রহ করা রক্ত যকৃতের দিকে প্রবাহিত হয়। এই রক্তে পুষ্টি ও অন্যান্য পদার্থ থাকে, যা যকৃত বিশ্লেষণ ও সংরক্ষণ করে।
2. হেপাটিক আর্টারির ছিদ্র (Opening of Hepatic Artery) : এই ছিদ্রের মাধ্যমে অক্সিজেন যুক্ত রক্ত যকৃতের লোবিউলে সরবরাহ করা হয়। এটি যকৃতের কোশ গুলিকে অক্সিজেন প্রদান করে।
3. বাইল ডাক্টের ছিদ্র (Opening of Bile Duct) : এই ছিদ্রের মাধ্যমে হেপাটোসাইটস থেকে উৎপন্ন পিত্তরস সংগ্রহ করা হয়। পরে এই পিত্তরস ডিওডেনামে (Duodenum) প্রবাহিত হয়ে খাদ্য পরিপাক প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে।
পোর্টাল ট্রায়াডের মাধ্যমে যকৃত রক্ত পরিষ্কার, পুষ্টি সংগ্রহ এবং পিত্তরস নিঃসরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যকৃতের কার্যাবলী (Functions of Liver) :-
যকৃত শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। এর প্রধান কার্যাবলী নিম্নরূপ:
1. পিত্তরসের নিঃসরণ ও সংশ্লেষণ (Secretion and Synthesis of Bile): যকৃত পিত্তরস উৎপন্ন করে, যা লিপিড পরিপাকে সাহায্য করে। পিত্তরস লিপিডকে ছোট ছোট কণায় ভেঙে দেয় (এমালসিফিকেশন)।
2. কার্বোহাইড্রেট বিপাক (Carbohydrate Metabolism) :-
যকৃত শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
• গ্লাইকোজেনেসিস (Glycogenesis) : রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেনে রূপান্তর করে যকৃত ও পেশিতে সঞ্চয় করা।
• গ্লাইকোজেনোলাইসিস (Glycogenolysis): প্রয়োজন হলে গ্লাইকোজেনকে গ্লুকোজে ভেঙে রক্তে সরবরাহ করা।
• গ্লুকোনিওজেনেসিস (Gluconeogenesis) : প্রোটিন বা ফ্যাট থেকে নতুন গ্লুকোজ তৈরি করা।
• গ্লাইকোনিওজেনেসিস (Glyconeogenesis): প্রোটিন বা ফ্যাট থেকে গ্লাইকোজেন গঠন করা।
3. ফ্যাট সঞ্চয় (Storage of Fats) : যকৃত লিপিড বা চর্বি সঞ্চয় করে এবং প্রয়োজন হলে তা শক্তিতে রূপান্তর করে।
4. ডিএমিনেশন এবং ইউরিয়া গঠন (Deamination and Urea Formation) : যকৃত প্রোটিন বিপাকের সময় অ্যামিনো অ্যাসিডের ডিএমিনেশন করে। এই প্রক্রিয়ায় অ্যামোনিয়া উৎপন্ন হয়, যা যকৃত ইউরিয়াতে রূপান্তর করে এবং মূত্রের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়।
যকৃতের অন্যান্য কার্যাবলী (Others Functions of Liver) - বিস্তারিত ব্যাখ্যা :-
1. রক্ত শুদ্ধকরণ (Purification of Blood) :-
• যকৃত রক্ত থেকে বিষাক্ত পদার্থ, যেমন অ্যালকোহল, মাদকদ্রব্য, এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন করে।
• এটি ফিল্টার হিসেবে কাজ করে এবং রক্তে থাকা বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থকে অ্যামোনিয়া এবং ক্রিয়েটিনিন এর মতো ক্ষতিকর পদার্থকে সুনির্দিষ্টভাবে শরীর থেকে বের করে দেয়।
• যকৃতের কুফার কোশ (Kupffer cells) রক্তে উপস্থিত জীবাণু এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত কোশের অবশিষ্টাংশও পরিষ্কার করে।
2. প্লাজমা প্রোটিনের সংশ্লেষণ (Synthesis of Plasma Proteins):
• যকৃত শরীরে প্লাজমা প্রোটিন যেমন আলবুমিন, গ্লোবিউলিন (আলফা এবং বিটা), এবং ফাইব্রিনোজেন তৈরি করে।
• আলবুমিন রক্তে জলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং গ্লোবিউলিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। গামা-গ্লোবিউলিন (Gamma-globulins) যকৃতের দ্বারা সংশ্লেষিত হয় না। গামা-গ্লোবিউলিন আসলে অ্যান্টিবডি (antibodies) বা ইমিউনোগ্লোবুলিন (immunoglobulins) নামে পরিচিত যা মূলত প্লাজমা সেলস (plasma cells) দ্বারা তৈরি হয়।
• ফাইব্রিনোজেন রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা রক্তপাত বন্ধ করতে সহায়ক।
3. হেপারিনের সংশ্লেষণ (Synthesis of Heparin):
• হেপারিন একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিকোঅ্যাগুল্যেন্ট (Anticoagulant) যা রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে।
• এটি যকৃতের কোষ দ্বারা তৈরি হয় এবং রক্তের সাধারণ প্রবাহ বজায় রাখতে সাহায্য করে, যা অস্বাভাবিক রক্ত জমাট বাঁধা রোধ করে।
4. ভিটামিনের সংশ্লেষণ (Synthesis of Vitamins) :
• যকৃত ভিটামিন A, D, K, এবং B12 এর মতো ভিটামিনগুলি সংশ্লেষণ এবং সংরক্ষণ করে।
5. ডিটক্সিফিকেশন (Detoxification) :
• যকৃত শরীরের বিষাক্ত বা বিপজ্জনক পদার্থগুলি পরিশোধন এবং নিষ্ক্রিয় করে।
• এটি অ্যালকোহল, মাদকদ্রব্য, রাসায়নিক এবং বিপদজনক পদার্থগুলিকে বিশ্লেষণ করে এবং শরীরের জন্য নিরাপদ রূপে রূপান্তরিত করে, যা পরে প্রস্রাব বা মলের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়।
6. হেমোপোইসিস (Haemopoiesis) :
• যকৃত গর্ভাবস্থায় হেমোপোইসিস (রক্তকণিকা উৎপাদন) করে।
• যদিও জন্মের পর এই কাজটি অস্থি মজ্জার (Bone marrow) দ্বারা করা হয়, তবে যকৃত গর্ভাবস্থায় রক্তকণিকা উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
7. এনজাইম নিঃসরণ (Secretion of Enzymes):
• যকৃত কিছু গুরুত্বপূর্ণ উৎসেচক (যেমন, Alkaline Phosphatase, AST (Aspartate Aminotransferase) এবং ALT (Alanine Aminotransferase) উৎপন্ন করে, যা পাচনতন্ত্রের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়।
• এই উৎসেচকগুলি পাচনে সাহায্য করে এবং যকৃতের কার্যকলাপ নিরীক্ষণে সহায়ক হয়।
উপসংহার :
যকৃত শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়া পরিচালনা করে, যেমন রক্ত পরিশোধন, প্লাজমা প্রোটিনের তৈরি, ভিটামিন এবং হেপারিনের সংশ্লেষণ, ডিটক্সিফিকেশন, হেমোপোইসিস এবং বিভিন্ন এনজাইম নিঃসরণ। এসব কাজের মাধ্যমে যকৃত দেহের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।