অনেক ব্যাকটেরিয়া আছে যারা মাটিতে নাইট্রোজেন আবদ্ধ করে মাটির উর্বরতা বাড়ায় ও গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ মাটিতে মুক্তজীবী হিসেবে থেকে নাইট্রোজেন আবদ্ধ করে, আবার কিছু ব্যাকটেরিয়া কোনো কোনো গাছের মূলে মিথোজীবী রূপে অর্বুদ সৃষ্টি করে এবং নাইট্রোজেন আবদ্ধ করে। নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী জীবজ সার হিসেবে কিছু ব্যাকটেরিয়া এবং সায়ানোব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়। এরা স্বাধীনজীবী এবং মিথোজীবী, উভয় প্রকৃতির হয়।এই প্রকার ব্যাকটেরিয়ার বিবরণ দেওয়া হল।
1. স্বাধীনজীবী N₂ স্থিতিকারী ব্যাকটেরিয়া (Free living N₂ fixing bacteria) : জীবজ সার হিসেবে মাটিতে বসবাসকারী বেশ কিছু নাইট্রোজেন স্থিতিকারী ব্যাকটেরিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরা পরিবেশের নাইট্রোজেনকে আবদ্ধ করে নাইট্রোজেন লবণে পরিণত করে মাটির নাইট্রোজেন ভাঙার বৃদ্ধি করে।
উদাহরণ: উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাইট্রোজেন স্থিতিকারী স্বাধীনজীবী ব্যাকটেরিয়া হল—Azotobacter, Derxia, Beijerinckia, Clostridium, Polymyxa, Chromatium, Rhodospirillum, Acetobacter প্রভৃতি। এইসব অণুজীবদের জীবজ সার হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন কৃষিজ উদ্ভিদ, যেমন—ধান, গম, বার্লি, জোয়ার, ভুট্টা, আখ, কার্পাস, আলু, কপি, গাজর ইত্যাদির উৎপাদন মাত্রা 15-20% বৃদ্ধি পায়
2. মিথোজীবী N₂ স্থিতিকারী ব্যাকটেরিয়া (Symbiotic N₂ fixing bacteria): মিথোজীবী নাইট্রোজেন স্থিতিকারী ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল Rhizobium sp.। এ ছাড়া Frankia sp. Xanthomonas sp., Bradyrhizobium sp. প্রভৃতি ব্যাকটেরিয়াও মিথোজীবীয়ভাবে নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে এবং জীবজ সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ: (i) বিভিন্ন প্রজাতির Rhizobium ব্যাকটেরিয়া শিম্বগোত্রীয় নানান উদ্ভিদের (ধনচে, মটর, শিম, বিন, আলফালফা ইত্যাদি) মূলে গুটি বা অর্বুদ সৃষ্টি করে। এরা পরিবেশের নাইট্রোজেনকে আবদ্ধ করে বিভিন্ন নাইট্রোজেন-জাত যৌগ গঠন করে এবং পোষক উদ্ভিদকে তার প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন সরবরাহ করে। ফসল ওঠার পর অর্বুদসহ ওইসব উদ্ভিদের মূল মাটিতে থেকে যায় এবং মাটির নাইট্রোজেন ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে। দেখা গেছে, Rhizobium-এর বিভিন্ন প্রজাতি ও শিম্বগোত্রীয় উদ্ভিদের মিথোজীবীয় সংগঠন প্রায় 40-150 kg N/ha / year জমিতে যুক্ত করছে এবং ডাল-জাতীয় শস্যের 20% ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে।
(ii) বেশ কিছু অশিম্বগোত্রীয় উদ্ভিদের (Casurina sp, Ainus sp, Myrica sp Rubus sp.) মূলে Frankia sp নামে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে, যারা অর্বুদ গঠন করে এবং মিথোজীবীয়ভাবে নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে।
(iii) Xanthomonas নামক ব্যাকটেরিয়া Ardisia নামক উদ্ভিদের পাতায় অর্বুদ বা গুটি তৈরি করে মিথোজীবীয় সহবস্থান করে। এইসব গাছের পাতা নাইট্রোজেনের উৎস হিসেবে কাজ করে। ফলে এই গাছের পাতা নাইট্রোজেন সার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
(iv) সয়াবিন (Glycine max) উদ্ভিদের মুলের অর্বুদে Bradyrhizobium japonicum ব্যাকটেরিয়া মিথোজীবী রূপে বসবাস করে। এগুলি বায়ুর নাইট্রোজেনকে অ্যামোনিয়া (NH₃) অথবা অ্যামোনিয়াম (NH₄⁺) আয়ন রূপে আবদ্ধ করে। এদের Nif এবং fix জিনগুলি নাইট্রোজেন আবদ্ধকরণে সাহায্য করে থাকে।
3. N₂ স্থিতিকারী স্বাধীনজীবী সায়ানোব্যাকটেরিয়া (Free living N, fixing_cyanobacteria) : সায়ানোব্যাকটেরিয়ার বিভিন্ন প্রজাতি যেমন— Nostoc (N. linuia), Anabaena (A. variabilis), Aulosira sp., Calothrix sp., Tolypothrix (T. tennis), Cylindrospermum sp., Stigonema sp. প্রভৃতি প্রধানত ধান, আখ ও ভুট্টার খেতে N₂ স্থিতিকারী হিসেবে উল্লেখযোগ্য। এইসব সায়ানোব্যাকটেরিয়াতে নাইট্রোজেন আবদ্ধকারী জিন বা নিক্ জিন (NIF gene) থাকে বলে এরা নাইট্রোজেন আবদ্ধ করতে পারে। তা ছাড়া ব্যাকটেরিয়ার কোশে নাইট্রোজিনেজ (nitrogenase) ও হাইড্রোজিনেজ (hydrogenase) নামক দুটি উৎসেচক থাকে, যেগুলি নাইট্রোজেন সংবন্ধনে সাহায্য করে। এদের নাইট্রোজেন সংবন্ধনের পরিমাণ 20-30 kg N/ha/year। দেখা গেছে, কৃষিজমিতে এই সায়ানোব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে শস্যের ফলন 30-50% বাড়ানো সম্ভব।
4. N₂ স্থিতিকারী মিথোজীবীর সারানোব্যাকটেরিয়া (Symbiotic N₂ fixing bacteria) : ধানখেতের ক্ষুদ্র ফার্ন Azolla pinnata-এর পাতার গহ্বরে Anabaena azollae নামক নাইট্রোজেন স্থিতিকারী মিথোজীবীয় ব্যাকটেরিয়া থাকে এবং নাইট্রেজেন সংবন্ধন করে। সংবন্ধিত নাইট্রোজেন পাতার গহ্বরে থাকে। ফার্নগুলি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং তাদের জীবনচক্র সম্পূর্ণ করে। এগুলি পচলে ধানের খেতে প্রচুর নাইট্রোজেন সার যুক্ত হয়। ধানখেতে এদের নাইট্রোজেন সংবন্ধনের পরিমাণ প্রতি মরশুমে 40-60 kg N/ ha ।
জীবজ সার হিসেবে সায়ানোব্যাকটেরিয়া ব্যবহারের সুবিধা : ধানখেতের মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সায়ানোব্যাকটেরিয়া বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কৃষিজমিতে সায়ানোব্যাকটেরিয়া ব্যবহারের সুবিধাগুলি হল –
(i) অল্প সময়ে অতিদ্রুত মাটির নাইট্রোজেন মাত্রা বৃদ্ধি করে।
(ii) মাটির অম্ল ক্ষারের ভারসাম্য রক্ষা করে। মাটির সছিদ্রতা বাড়িয়ে মাটির জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
(iii) মাটিতে ফসফেটের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া উদ্ভিদের বৃদ্ধি সহায়ক বিভিন্ন জৈব বস্তুর (হরমোন, অ্যামিনো অ্যাসিড ইত্যাদি) সংযোজন ঘটায়।
(iv) এইপ্রকার জৈব সার স্বল্পমূল্যের হওয়ায় কৃষকদের কাছে সাশ্রয়কারী।
(v) জীবজ উৎস থেকে উৎপন্ন বলে এই সার পরিবেশবান্ধবও বটে।
5. ফসফরাস দ্রবণকারী ব্যাকটেরিয়া (Phosphate solubilising bacteria) : ফসফরাস সরবরাহকারী সার হিসেবে কিছু ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়। এরা এদের দেহে নিঃসৃত বিভিন্ন জৈব অ্যাসিড ও ফসফাটেজ উৎসেচকের সাহায্যে মাটির অদ্রবণীয় ফসফেট লবণকে জৈব দ্রবণীয় ফসফেট লবণে (H₂PO₄⁻ ও HPO₄⁻² ) পরিণত করে। এদের প্রয়োগ করে ফসলের উৎপাদন 10-20% বৃদ্ধি পায়। এদের দ্বারা গ্রহণযোগ্য ফসফরাস সরবরাহের মাত্রা 30-50 kg P₂O₅ / ha / year |
উদাহরণ: Thiobacillus sp, Micrococcus sp. , Microbacterium sp.